Ticker

100/recent/ticker-posts

তারিখ ও সময়

[ | | ]

"রাজদরবারে আলিমদের গমন : একটি সতর্কবার্তা" বইয়ের ব্যাপারে একটি সতর্কবার্তা

"রাজদরবারে আলিমদের গমন : একটি সতর্কবার্তা" বইয়ের ব্যাপারে একটি সতর্কবার্তা 


বইয়ের নাম : রাজদরবারে আলিমদের গমন : একটি সতর্কবার্তা
লেখক : ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহিমাহুল্লাহ
অনুবাদক : আলী হাসান উসামা
প্রকাশক : মাকতাবাতুল বায়ান

মূল বই এবং মূল লেখক অর্থাৎ ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহিমাহুল্লাহ-এর ব্যাপারে আমাদের কোনই অভিযোগ নেই। এখানে যিনি অনুবাদক, পাঠকদের সাথে তার খেয়ানতি ও ধোঁকাবাজি নিয়ে এ লেখার অবতারণা। শুধু পাঠকদের সাথে-ই নয়; বরং রাসূল স. এর সাথেও তিনি খেয়ানতি ও ধোঁকাবাজি করেছেন।

অনুবাদক তার মুখবন্ধে লিখেছেন, "ইমাম সুয়ুতি রাহি. রচিত বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে যে-সকল জাল, ভিত্তিহীন এবং অপ্রমাণিত বর্ণনা উল্লিখিত হয়েছিল, আমরা সবশ্রেণির পাঠকের কথা বিবেচনা করে অনুবাদ থেকে সে-সকল বর্ণনা বাদ দিয়ে দিয়েছি। যা-কিছু হাদীস-বিশারদগণের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ এবং যার বর্ণনাসূত্র মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে প্রমাণিত, আমরা এ গ্রন্থে শুধু তা-ই উল্লেখ করেছি।" (পৃষ্ঠা, ১৯ )

এখানে অনুবাদক পাঠকদের অঙ্গীকার ও নিশ্চয়তা দিলেন যে, এ অনুবাদ-গ্রন্থে কোনো জাল, যঈফ ও ভিত্তিহীন বর্ণনা উল্লেখ থাকবে না। যা-কিছু উল্লেখ থাকবে, সবগুলোই প্রমাণিত বা সহীহ।

তিনি আরও লিখেছেন, "বক্ষ্যমাণ গ্রন্থের অনুবাদের ক্ষেত্রে আমরা যে-সকল নুসখার ওপর নির্ভর করেছি দারুস সাহাবাহ লিততুরাস; পাণ্ডুলিপি, আলমাকতাবাতুল আযহারিয়্যাহ; পোর্টেবল ডকুমেন্ট ফরম্যাট (PDF), মিম্বারুত তাওহীদ ওয়াল জিহাদ; নুসখা, আলমাকাতাবুশ শামিলাহ।" (পৃষ্ঠা, ১৯)

নুসখা সম্পর্কে অনুবাদকের জ্ঞান না-থাকায় অথবা জেনেশুনে এখানেও পাঠকদের যে-বিভ্রান্তিতে ফেলতে চেয়েছেন, সে-কথা না-হয় আজ থাক। আমরা যে-কথা বলতে চাচ্ছি, তা হল, অনুবাদের সময় অনুবাদকের কাছে 'দারুস সাহাবাহ লিততুরাস' এর নুসখা ছিল। 'দারুস সাহাবাহ লিততুরাস' থেকে প্রকাশিত নুসখার তাহকীক করেছেন মাজদী ফাতহী সাইয়িদ। মাজদী ফাতহী সাইয়িদ, তিনি হাদীসের সহীহ-যঈফ এর হুকুম লাগিয়েছেন। তার মানে, অনুবাদক অনুবাদের সময় জানতেন কোন হাদীস প্রমাণিত আর কোনটা অপ্রমাণিত। তাছাড়া তিনি মাজদী ফাতহী সাইয়িদের লাগানো হুকুম না-জানলেও তার ওপর আবশ্যক হচ্ছে, প্রতিটি হাদীসের হুকুম নিজে-ই যাচাই-বাছাই করে, অপ্রমাণিত হাদীস অনুবাদ থেকে বাদ দেওয়া। কারণ, তিনি পাঠকদের অঙ্গীকার ও আশ্বস্ত করেছেন, অনুবাদ-গ্রন্থে কোনো অপ্রমাণিত বর্ণনা থাকবে না।

অনুবাদক পাঠকদের যে অঙ্গীকার দিয়েছেন, তা পূর্ণ করেছেন, নাকি তার খেয়ানতি ও ধোঁকাবাজি করেছেন- তা জানতে আমরা শুধু মারফূ' বর্ণনাগুলো (রাসূল স. এর দিকে সম্পৃক্ত হাদীস) যাচাই করব। সালাফদের উক্তিগুলোর প্রমাণিত, না অপ্রমাণিত-তা যাচাই করা হবে না। মারফূ' বর্ণনাগুলোর পরিসংখ্যান থেকে সালাফদের উক্তিগুলোর শুদ্ধতার ব্যাপারে একটা ধারনা চলে আসবে।

এ যাচাইয়ের ক্ষেত্রে আমরা মাজদী ফাতহী সাইয়িদের তাহকীকের ওপর নির্ভর করেছি। যেহেতু সে-তাহকীক অনুবাদকের কাছে ছিল। অনূদিত বইয়ে মোট মারফূ' হাদীস আছে ৩৯ টি। কিন্তু মাজদী ফাতহী সাইয়িদের নুসখায় অনূদিত বইয়ের ২৯ ও ৩০ নাম্বার দু'টি হাদীস পাইনি। তার মানে অনূদিত বইয়ের ৩৭ হাদীস মাজদী ফাতহী সাইয়িদের নুসখায় রয়েছে। তন্মধ্যে মাজদী ফাতহী ৩৩ নাম্বার হাদীসের কোনো হুকুম লাগাননি। তাহলে মোট হাদীস দাঁড়াচ্ছে ৩৬ টি। এবার দেখি ৩৬টি হাদীসের মধ্যে কয়টি হাদীস অপ্রমাণিত। অনূদিত বইয়ের নাম্বার অনুযায়ী হাদীসের হুকুম তুলে ধরা হল :
৪,৫,৬,৭,১২,১৩,১৪,১৫,১৮,১৯,২০,২২,২৩,২৪,২৫,২৭,২৮ (সানাদ যঈফ) ,৩১,৩২,৩৭,৩৮ ৩৯ নাম্বার হাদীস যঈফ, আর ১৬ ও ১৭ নাম্বার হাদীসটি অত্যন্ত যঈফ।

এই হল পাঠকদের সাথে অনুবাদকের আমানতদারিতা ও অঙ্গীকার রক্ষা। ৩৬টা হাদীসের মধ্যে ২৪টি হাদীস অপ্রমাণিত। মাত্র ১২ টি হাদীস প্রমাণিত। তিনি জেনেশুনে এসব অপ্রমাণিত হাদীস ধোঁকাবাজি করে উল্লেখ করেছেন।

হয়তো বলতে পারেন, অনুবাদক 'অপ্রমাণিত বর্ণনা' দ্বারা 'যঈফ হাদীস' বুঝাননি। এমন দাবী তারাই করবে, যারা হাদীস ও মুহাদ্দিসদের পরিভাষা সম্পর্কে একেবারেই জাহিল। এ দাবী তিন কারণে বাতিল।
১. মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় যঈফ হাদীসও অপ্রমাণিত।
২. অনুবাদক শুধু 'যঈফ' হাদীস-ই উল্লেখ করেননি, অত্যন্ত যঈফ, দুর্বল হাদীসও উল্লেখ করেছেন।
৩. তিনি অনুবাদের সময় মূল বই থেকে এমন কিছু হাদীস বাদ দিয়েছেন, যা যঈফ। তাই অনুবাদকের কাছে যঈফ হাদীস অপ্রমাণিত না-হলে, সে-হাদীসগুলো বাদ দিতেন না।

এ আপত্তিও উত্থাপিত হতে পারে যে, যঈফ হাদীস থাকার দোষ শুধু অনুবাদকের ঘাড়ে কেন চাপবে? মূল লেখক তথা ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহিমাহুল্লাহ-এর ঘাড়ে কেন চাপবে না? শুধু অনুবাদকের ঘাড়ে চাপবে, কারণ, তিনি শর্ত করেছেন, অনূদিত বইয়ে কোনো অপ্রমাণিত হাদীস থাকবে না; কিন্তু ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহিমাহুল্লাহ এ শর্ত করেননি।

অনুবাদকের আরেকটি মহা খেয়ানত দেখুন। তিনি হাদীসের যে-তাখরীজ (উৎস গ্রন্থ উল্লেখকরণ) উল্লেখ করেছেন, তা মূলত মাজদী ফাতহী সাইয়িদের। এখানে আমানতদারিতার দাবী ছিল, উল্লেখ করে দেওয়া যে, অনূদিত বইয়ের তাখরীজ নেওয়া হয়েছে মাজদী ফাতহী সাইয়িদ থেকে। কিন্তু তিনি এ আমানতদারিতার গলায় সযত্নে ছুরি চালিয়েছেন। একটিবারের জন্যেও তা উল্লেখ করেননি। যেন বুঝাতে চেয়েছেন, অনূদিত বইয়ের তাখরীজ আমারই শ্রমের ফসল।

রাসূল স. বলেছেন, "যে জেনেশুনে আমার ওপর মিথ্যারোপ করবে, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে নির্ধারণ করে নিল।" (সহীহ বুখারী, হা/১২৯১)

ইমাম ইবনু হাজার হায়তামী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, "যে খাতীব খুতবায় হাদীস উল্লেখ করে; কিন্তু সে-সব হাদীস সহীহ, না সহীহ নয়- তা উল্লেখ করে না। তাকে কঠিন শাস্তি দিতে হবে। শাসকের দায়িত্ব হল, এমন খাতীবকে খুতবা দেওয়ার দায়িত্ব থেকে বহিষ্কার করা।" (আল-ফাতাওয়া আল-মাদীনিয়্যাহ, পৃষ্ঠা, ৩২)

হাদীসের হুকুম বর্ণনা না-করার কারণে যদি কঠিন শাস্তির অধিকারী হয়, তাহলে যারা 'প্রমাণিত হাদীসের দোহাই দিয়ে' ধোঁকাবাজি করে যঈফ ও অত্যন্ত দুর্বল হাদীস জনসাধারণকে গিলাতে চায়- এমন লোকদের কথা ইমাম ইবনু হাজার হায়তামী জানতে পারলে কী শাস্তির কথা বলতেন, তা সহজেই অনুমেয়।

বই পর্যালোচনায়: আব্দুল্লাহ মাহমূদ

Post a Comment

0 Comments